আগামী কয়েকদিন সারা দেশে তাপমাত্রা আরও কমবে। বাড়বে শীতের তীব্রতা, পাশাপাশি থাকবে কুয়াশার প্রকোপ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নীলফামারী জেলায় গতকাল শুক্রবার বয়ে গেছে মৌসুমের প্রথম মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, যা আজ শনিবারও চলতে পারে। এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হয়েছে।
সারা দেশেই ভোর ও রাতের দিকে কুয়াশা ও ঠান্ডা বাতাসের কারণে শীতের অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। সকালে কাজে বের হওয়া মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী, পথচারী ও ভাসমান জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। শীত থেকে বাঁচতে অনেককে খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে বা অস্থায়ী উষ্ণতার ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে।
গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজশাহীর বাঘাবাড়ি ও নীলফামারীর ডিমলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়; ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
দেশের ওপর এখন শীতের প্রভাব বাড়ার কারণ হিসেবে উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের কথা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটি বলছে, এ বলয়ের প্রভাবে দেশে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। এ বলয়ের বর্ধিতাংশ এখন পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।
আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নীলফামারী জেলায় যে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, সেটি এ মৌসুমের প্রথম। এমন আবহাওয়া ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হতে পারে।
পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। যশোর, চুয়াডাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নীলফামারী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, শনিবারও তা অব্যাহত থাকতে পারে। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত নদী অববাহিকার কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যত্র হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা থাকতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে দেশের অনেক জায়গায় ঠান্ডার অনুভূতি অব্যাহত থাকতে পারে। শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবওহাওয়া অফিস।
ঘন কুয়াশার কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। ঢাকাগামী পাঁচটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ভারতের কলকাতায় অবতরণ (ডাইভার্ট) করতে বাধ্য হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১টা থেকে শুক্রবার ভোর ৬টা পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, রাত ১টার পর থেকে রানওয়ে এলাকায় কুয়াশার ঘনত্ব বেড়ে গেলে অবতরণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ সময় কুয়েত থেকে ঢাকাগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট, জাজিরা এয়ারওয়েজের দুটি এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট নামতে না পেরে কলকাতা বিমানবন্দরে চলে যায়। এ ছাড়া রাত সাড়ে ৩টার দিকে দাম্মাম থেকে আসা বিমানের আরও একটি ফ্লাইট অবতরণে ব্যর্থ হয়ে কলকাতায় অবতরণ করে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ জানান, কুয়েত এয়ারলাইন্সসহ বেশকিছু ফ্লাইট ডাইভার্ট করে কলকাতা পাঠানো হয়েছে।
কুয়াশার কারণে শুধু ডাইভার্ট নয়, বড় ধরনের শিডিউল বিপর্যয়েও পড়েছেন যাত্রীরা। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের দুবাই থেকে আসা ফ্লাইট, বিমানের কুয়ালালামপুর ও গুয়াঞ্জু থেকে আসা ফ্লাইট, এয়ার অ্যারাবিয়ার শারজাহ এবং সালাম এয়ারের মাস্কাট থেকে আসা ফ্লাইটগুলো নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ২ থেকে ৪ ঘণ্টা বিলম্বে অবতরণ করেছে।
শীতকাল হওয়ায় মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত প্রায়ই ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে রানওয়ে। এতে আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীরা দীর্ঘ সময় বিমানে বা ভিন্ন দেশের বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিন ভোরে কুয়াশার এ দাপট অব্যাহত থাকতে পারে।
এদিকে হঠাৎ হাড়কাঁপানো শীতে জবুথবু অবস্থা যশোরবাসীর। গত তিন-চার দিন জেলায় প্রচণ্ড কুয়াশা ও হিমেল হাওয়া বইছে। দুপুরে সূর্যের দেখা মিললেও রোদের তাপমাত্রা ছিল কম। উত্তরী হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে প্রাণিকুল। বৃষ্টির মতো ঝিরঝির করে পড়ছে কুয়াশা। এতে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের মানুষ।
শহরের ধর্মতলা এলাকার রিকশাচালক শিমুল হোসেন বলেন, শীতে রিকশা চালাতে গিয়ে হাত-পা জমে যাচ্ছে। ব্রেকও ঠিকমতো ধরা যাচ্ছে না, দুর্ঘটনার ভয় বাড়ছে।
ঘন কুয়াশার কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল যমুনা সেতু মহাসড়ক যানবাহনের ধীরগতি। দুর্ঘটনার আশঙ্কায় হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে চলাচল করছে সব ধরনের যানবাহন। গতকাল ভোরে যমুনা সেতু পূর্ব ইব্রাহীমাবাদ রেলস্টেশন, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড ও রাবনা বাইপাস এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
একতা পরিবহনের চালক সুমন মিয়া বলেন, আমি ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাচ্ছি। ভোর থেকেই কুয়াশা খুব বেশি। সামনে কী আছে বোঝা যায় না, তাই হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছি।
চট্টগ্রাম থেকে পাবনাগামী ট্রাকচালক আব্দুল আলিম বলেন, ঘন কুয়াশায় কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পূর্ব পর্যন্ত সড়কের কাজ চলমান থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি। তাই কম গতিতে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছি।
মৌসুমের সর্বনিম্ন দশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাঁপছে সিরাজগঞ্জের যমুনা পারের মানুষ। প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় নাকাল হয়ে পড়েছে যমুনা নদীর চরাঞ্চলের মানুষগুলো। দেখা মেলেনি সূর্যের। প্রচণ্ড শীতে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষগুলো পড়েছে বিপাকে। তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে না পারায় কমে গেছে আয়।
রিকশা শ্রমিক উজ্জ্বল হোসেন বলেন, শুক্রবার আমাদের বেশি কাজকাম হয়। শহরে অনেক মানুষ ঘুরতে আসে। কিন্তু শীতের কারণে শহরে মানুষের সংখ্যা খুব কম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমাদের কেউ কেউ ১০০ টাকাও রোজগার করতে পারেনি।
সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক সোহেল ও মুকুল বলেন, সকাল থেকে বসে রয়েছি। কোনো ভাড়া মিলছে না। এভাবে থাকলে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়বে।
পাবনায়ও শীত জেঁকে বসেছে। ঘন কুয়াশা এবং হাড়কাঁপানো শীতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না খুব একটা। দুপুর পর্যন্ত প্রকৃতি ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে। হাড়কাঁপানো শীতে পদ্মা-যমুনা নদীর চরাঞ্চলের দুই লক্ষাধিক মানুষসহ অন্তত পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। শীতে কাজ করতে না পারায় মানবেতর দিনযাপন করছেন তারা।
পৌষের দ্বিতীয় সপ্তাহে তীব্র শীতে কাঁপতে শুরু করেছে উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামের মানুষ। টানা তিন দিন ধরে ১১-এর ঘরে অবস্থান করছে এ অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায় হাড়কাঁপানো শীতের সঙ্গে বেড়েই চলছে কুয়াশার দাপট। সেইসঙ্গে উত্তরীয় হিমেল বাতাসে কাবু হয়ে পড়েছে এ জনপদের মানুষ। চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে-খাওয়া, দিনমজুর, নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষসহ জেলার পাঁচ শতাধিক চর ও দ্বীপ চরের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল মানুষ।
কুড়িগ্রাম সদরের উত্তর নওয়াবস এলাকার রিকশাচালক আবুল কাশেম বলেন, কয়েকদিন ধরে তীব্র ঠান্ডা চলছে। খুব সকালে রিকশা নিয়ে বের হলেও ঠান্ডার কারণে দীর্ঘ সময়েও যাত্রী মিলছে না। এতে আয়ে ভাটা পড়ায় আমরা পরিবারের ব্যয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।
কৃষি শ্রমিক খসমত বলেন, কাজের সন্ধানে বেরিয়ে ঠান্ডায় হাত-পা কাঁপতেছে। ঠান্ডায় জীবন বাঁচানো মুশকিল। কিন্তু কাজকাম না করলে তো পেটে ভাত যাবে না।
একই পরিস্থিতি কুড়িগ্রামের কাঁচিচর এলাকার মাটি কাটা শ্রমিক ভারত চন্দ্রের। তিনি বলেন, ঠান্ডায় কোদাল হাত দিয়ে ধরলে হাত শিক লাগে। পেট তো আর ঠান্ডা বোঝে না। তাই কষ্টকর হলেও কাজ করতে হবে। নইলে পরিবারের ভরণপোষণ চালাব কীভাবে?
পাঁচগাছি ইউনিয়নের মাছ বিক্রেতা হরেন্দ্র নাথ বলেন, এ ঠান্ডায় খুব বিপদে আছি। পানি নাড়লে হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হচ্ছে। মাছ বিক্রি না করলে খাব কী?
অন্যদিকে, শীত বাড়লেও চরাঞ্চলে এখনো পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র পৌঁছেনি। অনেক এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে ঘন কুয়াশা ও কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। পৌষের শুরুতেই উত্তরের জনপদ নীলফামারীর ডিমলায় জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ, নিম্ন আয়ের পরিবার এবং তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের বাসিন্দারা।
ডালিয়া নতুন বাজার এলাকায় পাথরের সাইটে কাজের অপেক্ষায় থাকা বাইশপুকুর গ্রামের শ্রমিক লাল মিয়া বলেন, কুয়াশা আর শীতের কারণে সাইটে কাজ বন্ধ। দুদিন ধরে এসে ফিরে যাচ্ছি।
চুয়াডাঙ্গায় হাড়কাঁপানো শীতে জবুথবু মানুষ ও প্রাণিকুল। সূর্যের সামান্য রোদের উষ্ণতা আশীর্বাদ হয়েছে এ জনপদের মানুষের। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাজে বের হচ্ছেন না। শীতে দুর্ভোগে পড়েছে খেটে-খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ।
ঘন কুয়াশার কারণে বরিশালে সূর্যের দেখা মেলেনি। এ কারণে শীতের তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আগামী দু-চার দিনে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা আরও কমবে বলে জানিয়েছেন বরিশাল আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মাসুদ রানা রুবেল। তিনি জানিয়েছেন, ডিসেম্বর ও জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কমে থাকে। সেই অনুযায়ী সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও কমবে। তবে শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা নেই। অবশ্য বরিশাল বিভাগের নদী এবং সড়ক পথে শুক্রবার মধ্যরাত ভোর পর্যন্ত নদী ঘন কুয়াশা থাকবে।

✍️ মন্তব্য লিখুন