নাজিমিয়া দরবার শরিফ নুরানির আলোয় ভাসমান
এম জি বাবর: নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর ইউনিয়নের পদুয়া গ্রামের ৭ নং ওয়ার্ডে এক শান্ত, নির্জন, অথচ নুরানিতে ভরা স্থান, নাজিমিয়া দরবার শরিফ। সময়ের পর্দা সরালে ইতিহাস সাক্ষী দেয়, প্রায় আট শত বছর পূর্বে আরব দেশের এক মহান অলিকে নিয়ে এই ভূমিতে বরকতের সূচনা হয়। তিনি ছিলেন হযরত মিয়া নুর শাহ (রহ.), যিনি মারফতের নূরে আলোকিত হয়ে এই বাংলার মাটিতে আস্তানা গড়ে তোলেন। তাঁর আগমনে পদুয়ার ধূলিকণাও যেন দ্যুতিময় হয়ে ওঠে, জেগে ওঠে আল্লাহভক্তি ও মানবসেবার পথ।পুকুরের পূর্ব পাশে আজও তাঁর মাজার শরিফ দাঁড়িয়ে আছে অনন্ত শান্তির প্রতীক হয়ে। চারপাশে জিকিরের ধ্বনি, মোমবাতির আলো, সুবাসিত আতরের গন্ধ আর ভক্তদের চোখের অশ্রু যেন এক অবিরাম আত্মসমর্পণের ধারা।আস্তানার উত্তরাধিকার হাফেজ নাজিম উদ্দিন শাহ,এই দরবারের বর্তমান পীর হাফেজ মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন শাহ, যিনি পীরে মোকাস্মেল হিসেবে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে আজও দরবার শরিফের আধ্যাত্মিক ধারা জীবন্ত। তাঁর মাঝে দেখা যায় এক আশ্চর্য মিশ্রণ পীরের সৌম্যতা, শিক্ষকের মমতা, আর দার্শনিকের গভীরতা। এই আস্তানাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নাজিমিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা। এখানে এলাকার গরিব, অসহায় ও এতিম শিশুদের বিনা পয়সায় পড়াশোনা করানো হয়। তাদের আহার, পোশাক, ও থাকার সমস্ত ব্যবস্থা দরবারের উদ্যোগে পরিচালিত হয়। এটি শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এক আত্মিক শিক্ষালয়, যেখানে হৃদয় শুদ্ধ করার পাঠ চলে কোরআনের আলোয়।দান ও দরবারের ঐতিহ্য নাজিমিয়া দরবারে প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে মেহমান আসে। কেউ আসে কষ্ট নিয়ে, কেউ আশায়, কেউবা নিভৃতে আল্লাহর জিকিরে মগ্ন হতে। দরবারের ভক্তরা বলেন, এখানে একবার প্রবেশ করলে মন শান্ত হয়ে যায়, বুকের ভার হালকা হয়।প্রতিদিন দরবারে মানুষের আনাগোনা থাকলেও শুক্রবার দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জুমার নামাজের পর মিলাদ ও জিকির মাহফিল হয়, পরে তবারুক বিতরণ করা হয়। স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের মুরিদ ও আশেকানরা ভিড় জমান। আনুমানিক ২০০০ থেকে ২৫০০ জন পুরুষ ও নারী বিভিন্ন এলাকা হতে ও স্থানীয় পর্যায়ে মানুষ জনেরা ও তবারুকের খানায় অংশগ্রহন করে। আগন্তুক পুরুষেরা নামাজ, মিলাদ অংশ গ্রহন করে। ভক্তরা বলেন, পীর সাহেবের হেদায়েতি ছবক হয় চার তরিকার চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদিয়া। এক ভক্ত বলেন, তরিকত মানে আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত হওয়া। যে অন্তর কলুষমুক্ত, সেই হৃদয়েই আল্লাহর নূর প্রতিফলিত হয়। নির্মলতা ও শুদ্ধতার আদর্শ অনেক দরবারের সঙ্গে তুলনা করলে নাজিমিয়া দরবারে একটি বিশেষ দিক লক্ষ করা যায় এখানে কোনো শিরক, বেদাত বা কুসংস্কারকে স্থান নেই। মাজারে কেউ সিজদা দেয় না, বরং সবাই দোয়া করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে।একজন ভক্ত বলেন,“এখানে আমাদের শেখানো হয় আদব, তরিকার কাজ, পীর সাহেব আল্লাহকে পাবার পথ শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত, মারফতের পথ দীক্ষা দেন । এই দরবার আমাদের শেখায়, ইমান ও আমলের পথে স্থির থাকা।মানবসেবার আধ্যাত্মিক রূপ
নাজিমিয়া দরবারের আরেকটি বিশেষ দিক হলো সমাজসেবা। কোরবানির ঈদে পীর সাহেব নিজে তদারকি করে এলাকার গরিবদের মাঝে গোশত বিতরণ করেন। দরবারের তহবিল ও মুরিদদের দানের অর্থ দিয়ে প্রতিবছর বহু অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানো হয়। এই দানশীলতা কোনো দম্ভ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এক অন্তর্নিহিত প্রয়াস।
দরবারের মেহমানদারি ব্যবস্থা বিখ্যাত। দূর-দূরান্ত থেকে আগত আশেকানদের জন্য এখানে খাবার, থাকা, বিশ্রামের চমৎকার ব্যবস্থা আছে। হাফেজ নাজিম উদ্দিন শাহ নিজ হাতে খানা তদারকি করেন, ভক্তদের খোঁজখবর নেন যেন এক পরম মমতাময় পিতা।ওরসের মহাসমারোহ নুরের মেলা
প্রতি বছর দরবারে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক ওরস মোবারক। এটি শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক মিলনমেলা। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এলাকার ভক্তরাও অংশ নেন। কেউ নিয়ে আসেন দান, কেউ নিয়ে আসেন হাদিয়া, কেউবা শুধু দোয়ার আশা।সেদিন দরবারে বাতাসে ভেসে বেড়ায় আতরের গন্ধ, দোয়ার সুর, আর এক অপার্থিব শান্তি। পীর সাহেবের বক্তব্যে যেন মনের অন্ধকার কেটে যায়। তিনি মানুষকে আল্লাহভীতি, প্রেম ও সহানুভূতির পথে আহ্বান জানান।যে নিজের অহংকে ত্যাগ করতে পারে, সেই প্রকৃত মুরিদ। ত্যাগই মারফতের প্রথম পাঠ।হাফেজ নাজিম উদ্দিন শাহনাজিমিয়া দরবার নূরের এক প্রানকেন্দ্র,নাজিমিয়া দরবার শরিফ আজ শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়; এটি হয়ে উঠেছে নোয়াখালীর এক আধ্যাত্মিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে জিকিরের সুরে মিশে আছে মানুষের আশা, দুঃখ, ভালোবাসা, ও ত্যাগ।যে কেউ এখানে এসে উপলব্ধি করে আত্মা শান্তির জন্য শুধু ধনসম্পদ নয়, প্রয়োজন এক নূরানী সংযোগ। সেই সংযোগের নামই মারফত, যার শিক্ষা দেয় এই দরবারের প্রতিটি ইট, প্রতিটি দোয়া, প্রতিটি হাসি। দরবারের প্রতিটি ভাতের কণা, প্রতিটি দানের টাকাই যদি গরিবের মুখে হাসি ফোটায় তাহলেই স্বার্থকতা। আটশো বছরের ঐতিহ্য, নূরের ধারা, মানবতার দীক্ষা সব মিলিয়ে নাজিমিয়া দরবার শরিফ আজ নোয়াখালীর ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্মিক অবলম্বন। এখানে কেউ আসে হারানো শান্তি খুঁজতে, কেউ আসে আল্লাহর প্রেমে ডুব দিতে।এই দরবার যেন এক নূরানী বাগান যেখানে প্রতিটি ফুল হলো,একেকটি হৃদয়, আর প্রতিটি সুবাস আল্লাহর রহমতের বার্তা। সময় যতই বদলাক, এই আস্তানা থেকে ছড়িয়ে পড়া আলো অম্লান থাকবে চিরকাল মানবতার, আধ্যাত্মিকতার, আর মারফতের নূরে ভরা।
















