বিক্রি না বন্ধ—নভোএয়ার নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত আসছে!
লেখকঃ আনোয়ার বিন মাহামুদ (ব্লগার ও বিশ্লেষক)
বাংলাদেশের আকাশে বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থার পথচলা কখনোই মসৃণ ছিল না। তবু ২০১৩ সালে এক আত্মবিশ্বাসী যাত্রায় আত্মপ্রকাশ করে নভোএয়ার। ভিন্ন মানসিকতায়, সেবার মানে আলাদা করার লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল তাদের যাত্রা। এক দশক না পেরোতেই আজ সংস্থাটি বিক্রির মুখোমুখি। সম্ভাব্য বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা চলছে। ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রশ্ন জাগে—নভোএয়ার কি শুধু লোকসানের শিকার, না কি আমাদের গুটিকয়েক সাহসী বেসরকারি এয়ারলাইনস উদ্যোগের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি?
লোকসানের বৃত্তে ঘূর্ণন
নভোএয়ারের লোকসানের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে—বর্ধিত জেট ফুয়েল খরচ, আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া এবং কোভিড-পরবর্তী আর্থিক চাপে ঘাটতি। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ঋণ এবং ৩০ কোটি টাকার কর্মী দায়দেনা এখন টিকে থাকার প্রশ্নকে জটিল করে তুলেছে।
তবে শুধু অর্থনৈতিক হিসেবেই কি ব্যর্থতা বোঝা যায়? উত্তর ‘না’। আসলে এটাই এক ধরনের ‘স্ট্রাকচারাল ব্যর্থতা’—যেখানে অবকাঠামো আছে, কিন্তু কাঠামোগত সহায়তা নেই।
কেন বারবার ব্যর্থ হয় দেশীয় এয়ারলাইনস?
নভোএয়ারের আগে ইউনাইটেড, জিএমজি, রিজেন্ট—সবগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ইউএস বাংলা ও এয়ার অ্যাস্ট্রা টিকে আছে, তবে তারাও নানা চ্যালেঞ্জে জর্জরিত। আন্তর্জাতিক রুটে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমানের একচেটিয়া প্রভাব, বেসরকারি সংস্থার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিতে স্পষ্ট সমর্থনের অভাব এবং ব্যবসায়িক ঝুঁকিতে ঋণ সহযোগিতা না থাকা—এসবই ধ্বংস করে দিয়েছে সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
নভোএয়ার ছিল অভ্যন্তরীণ রুটের নির্ভরযোগ্য নাম। কিন্তু এতটুকু জায়গা নিয়েও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিক্রি না বন্ধ: কোনটা ভালো?
নভোএয়ারের বর্তমান কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে বিক্রির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করতে। এটিই আপাতত বাস্তবসম্মত ও আশাব্যঞ্জক পথ। তবে যেকোনো বিদেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠান যখন একটি দেশীয় সেবাদানকারী সংস্থা অধিগ্রহণ করে, তখন সেবা, কর্মসংস্থান এবং রুট ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের রদবদল হয়। প্রশ্ন থেকে যায়—দেশীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষা পাবে?
তবে একথা সত্য, এখন বিক্রিই প্রতিষ্ঠানটির জন্য ‘সম্মানজনক প্রস্থান’। বন্ধ হয়ে গেলে দায়দেনার চাপে কর্মীদের পাওনাও অনিশ্চয়তায় পড়বে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা কী?
এই সংকটে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ নীরবতা এক ধরনের অদূরদর্শিতার ইঙ্গিত দেয়। যেখানে ইউরোপ-আমেরিকায় সরকার বেসরকারি এয়ারলাইনসকে নানা সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখে, সেখানে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকেরা যেন সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন ‘বাজারের হাতে’। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মতো দেশে কি উড়োজাহাজ খাতকে নিছক ব্যবসা ভাবলেই চলে?
নভোএয়ারের বিপর্যয়ের পেছনে শুধুই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দায়ী নয়—রাষ্ট্রের উদাসীনতাও এক বড় দায়ী।
শেষ কথা
নভোএয়ারের অবস্থা আমাদের সামনে এক কঠিন সত্য তুলে ধরেছে—দেশীয় এয়ারলাইনস খাতে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত পরিকল্পনা না থাকলে, একের পর এক প্রতিষ্ঠান ডুবে যাবে। বিক্রি হোক বা বন্ধ—নভোএয়ারের গল্প যেন কেবল একটি সংস্থার পতন নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার একটি প্রতিচ্ছবি।
বাকিটা এখন সময় বলবে—নভোএয়ার কি নতুন মালিকানায় ফিরবে, নাকি ইতিহাসে আরেকটি “বন্ধ হয়ে যাওয়া” নাম হয়ে থাকবে।