০১:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

যুদ্ধ নয়, হতাশা: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে কেন ক্ষুব্ধ বিজেপি সমর্থকরা

ডেস্ক নিউজ

যখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় এবং দেশজুড়ে যুদ্ধাবস্থার গন্ধ ছড়াতে শুরু করে, তখন হঠাৎ করেই আসে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের একটি বড় অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে হতাশা, ক্ষোভ এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।

প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সংঘর্ষ

ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দীর্ঘদিন ধরে ‘শক্তিশালী নেতৃত্ব’ এবং ‘চূড়ান্ত প্রতিশোধের’ এক রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাম্পস্যুট পরা ছবি ও ‘যাচনা ন্যাহি, আব রণ হোগ্যা’ — এমন আগ্রাসী বার্তা জনমনে যুদ্ধের প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে।

এই পরিস্থিতিতে যখন যুদ্ধের বদলে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, অনেক সমর্থকের কাছে তা সরকারের ‘পিছু হটা’ হিসেবে প্রতিভাত হয়।

মার্কিন হস্তক্ষেপে ক্ষোভ

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তরফ থেকে, যেটি ভারতের জাতীয়তাবাদী অংশের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের মতে, ভারতের সার্বভৌম সিদ্ধান্তে বাইরের চাপ অগ্রহণযোগ্য। এমনকি ট্রাম্প যখন বলেন, “আমার পরবর্তী কাজ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান খোঁজা,” তখন এই মন্তব্য আরও ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে।

বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত একে ‘ধাক্কা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ভারতীয়দের অনেকেই এই সমঝোতা মেনে নিতে পারেননি।

‘শেষ কথা’ আশা করেছিলেন সমর্থকেরা

বিজেপি-আরএসএস ঘনিষ্ঠ অনেক সংগঠনের তরফ থেকে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখলই ছিল কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজের আহ্বায়ক সায়ন লাহিড়ী বলেন, “জনগণ একটি চূড়ান্ত সমাধান চেয়েছিল, আমরা পেয়েছি আপস।”

উগ্র সমর্থকেরা প্রকাশ্যে দাবি করছেন, পাকিস্তানকে ‘বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়াই’ ছিল তাঁদের লক্ষ্য।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ট্রল ও কটাক্ষ

পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র, যিনি যুদ্ধকালীন সময় নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত হামলার মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, তাঁকে নিজের প্রোফাইলের গোপনীয়তা সেটিংস পরিবর্তন করতে বাধ্য হতে হয়। মিশ্রের পরিবারের সদস্যদের নিয়েও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।

এই ঘটনায় বোঝা যায়, ‘যুদ্ধ না হওয়া’ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর জন্য কতটা আবেগপ্রবণ ও ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

রাজনৈতিক বয়ান বনাম কূটনৈতিক বাস্তবতা

বিজেপি সরকারের কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সামরিক হিসাব-নিকাশ যাই হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক বয়ান একেবারে ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে ‘শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ’, ‘শক্তির প্রদর্শন’ এবং ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচার চালানো হয়েছে। বাস্তবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত সেই বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।

এ কারণেই সমর্থকেরা এটিকে “পরাজয়” বা “আত্মসমর্পণ” হিসেবে চিহ্নিত করছেন, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির পক্ষে কৌশলগত ও মানবিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

উপসংহার

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির এই পর্বটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতা নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বয়ান, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল সম্পর্ককেও উন্মোচিত করেছে।

এই পর্বে প্রমাণিত হলো, একটি যুদ্ধ না হওয়াও অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে—যখন তা একটি শক্তিমত্তা-ভিত্তিক জনপ্রিয় ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ১২:৩৬:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

যুদ্ধ নয়, হতাশা: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে কেন ক্ষুব্ধ বিজেপি সমর্থকরা

আপডেট: ১২:৩৬:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

যখন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় এবং দেশজুড়ে যুদ্ধাবস্থার গন্ধ ছড়াতে শুরু করে, তখন হঠাৎ করেই আসে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। সীমান্তবর্তী সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের একটি বড় অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে হতাশা, ক্ষোভ এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।

প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার সংঘর্ষ

ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দীর্ঘদিন ধরে ‘শক্তিশালী নেতৃত্ব’ এবং ‘চূড়ান্ত প্রতিশোধের’ এক রাজনৈতিক বয়ান গড়ে তুলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাম্পস্যুট পরা ছবি ও ‘যাচনা ন্যাহি, আব রণ হোগ্যা’ — এমন আগ্রাসী বার্তা জনমনে যুদ্ধের প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে।

এই পরিস্থিতিতে যখন যুদ্ধের বদলে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে, অনেক সমর্থকের কাছে তা সরকারের ‘পিছু হটা’ হিসেবে প্রতিভাত হয়।

মার্কিন হস্তক্ষেপে ক্ষোভ

যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তরফ থেকে, যেটি ভারতের জাতীয়তাবাদী অংশের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের মতে, ভারতের সার্বভৌম সিদ্ধান্তে বাইরের চাপ অগ্রহণযোগ্য। এমনকি ট্রাম্প যখন বলেন, “আমার পরবর্তী কাজ কাশ্মীর সমস্যার সমাধান খোঁজা,” তখন এই মন্তব্য আরও ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে।

বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত একে ‘ধাক্কা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ভারতীয়দের অনেকেই এই সমঝোতা মেনে নিতে পারেননি।

‘শেষ কথা’ আশা করেছিলেন সমর্থকেরা

বিজেপি-আরএসএস ঘনিষ্ঠ অনেক সংগঠনের তরফ থেকে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দখলই ছিল কাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপ। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্রসমাজের আহ্বায়ক সায়ন লাহিড়ী বলেন, “জনগণ একটি চূড়ান্ত সমাধান চেয়েছিল, আমরা পেয়েছি আপস।”

উগ্র সমর্থকেরা প্রকাশ্যে দাবি করছেন, পাকিস্তানকে ‘বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়াই’ ছিল তাঁদের লক্ষ্য।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ট্রল ও কটাক্ষ

পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্র, যিনি যুদ্ধকালীন সময় নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত হামলার মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, তাঁকে নিজের প্রোফাইলের গোপনীয়তা সেটিংস পরিবর্তন করতে বাধ্য হতে হয়। মিশ্রের পরিবারের সদস্যদের নিয়েও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।

এই ঘটনায় বোঝা যায়, ‘যুদ্ধ না হওয়া’ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর জন্য কতটা আবেগপ্রবণ ও ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

রাজনৈতিক বয়ান বনাম কূটনৈতিক বাস্তবতা

বিজেপি সরকারের কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সামরিক হিসাব-নিকাশ যাই হোক না কেন, তাদের রাজনৈতিক বয়ান একেবারে ভিন্ন। দীর্ঘদিন ধরে ‘শত্রু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ’, ‘শক্তির প্রদর্শন’ এবং ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রচার চালানো হয়েছে। বাস্তবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত সেই বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।

এ কারণেই সমর্থকেরা এটিকে “পরাজয়” বা “আত্মসমর্পণ” হিসেবে চিহ্নিত করছেন, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির পক্ষে কৌশলগত ও মানবিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

উপসংহার

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির এই পর্বটি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত বাস্তবতা নয়, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বয়ান, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল সম্পর্ককেও উন্মোচিত করেছে।

এই পর্বে প্রমাণিত হলো, একটি যুদ্ধ না হওয়াও অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে—যখন তা একটি শক্তিমত্তা-ভিত্তিক জনপ্রিয় ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।