০৮:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন ইসরায়েল থেকে ফেরত দেওয়া মরদেহে

নিউজ ডেস্ক

গাজার দক্ষিণাঞ্চলের নাসের হাসপাতালের ছোট একটি ঘরে চলছে মরদেহ শনাক্তের লড়াই। নেই ডিএনএ পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা, নেই সংরক্ষণের জন্য হিমঘর— তবুও ফরেনসিক দল প্রাণপণ চেষ্টা করছে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল থেকে ফেরত পাওয়া শত শত দেহের পরিচয় নিশ্চিত করতে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গত এগারো দিনে ইসরায়েল ফেরত দিয়েছে ১৯৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ। এর বিনিময়ে গাজা থেকে ফেরত গেছে ১৩ ইসরায়েলি জিম্মির দেহ। কিন্তু ফেরত আসা মরদেহগুলোর অধিকাংশের দেহে নির্যাতনের ভয়াবহ চিহ্ন দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন চিকিৎসকেরা।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে— অনেক দেহই অচেনা, কেউ শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরা, কেউ সম্পূর্ণ উলঙ্গ। অধিকাংশ মরদেহে রয়েছে একাধিক আঘাতের চিহ্ন; কারও হাত বাঁধা, কারও চোখে কাপড়ের ফিতা।

নাসের হাসপাতালের ফরেনসিক ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ ধেইর বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জায়গার অভাব। দেহগুলো জমাট অবস্থায় আসে, গলতে সময় লাগে কয়েক দিন। ফলে ময়নাতদন্ত বা সঠিক পরিচয় যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। গলতে অপেক্ষা করলে দেহ পচে যায়— তাই যতটা পারি নমুনা সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করি।

আরেক ফরেনসিক সদস্য ডা. আলা আল-আস্তাল জানান, অনেক দেহেই দেখা গেছে কবজি ও গোড়ালির চারপাশে গভীর দাগ, রক্ত জমাট ও টিস্যু ক্ষয়। “কিছু ক্ষেত্রে বাঁধন এত শক্ত ছিল যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি চোখের চারপাশেও ফিতা বাঁধা থাকার দাগ দেখা গেছে,” বলেন তিনি।

গাজার প্রশাসনের সামেহ ইয়াসিন হামাদ বলেন, অনেক দেহে মৃত্যুর আগে মারধর, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, এমনকি ছুরিকাঘাতের চিহ্নও রয়েছে। বিবিসি যাচাই করা ছবিতেও দেখা গেছে কবজি ও পায়ে তারের বাঁধনের ছাপ, কোথাও ত্বক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ক্ষতচিহ্ন।

তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে কাজ করছে এবং ফেরত দেওয়া মরদেহগুলো গাজার যোদ্ধাদের।

আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এসব ছবিতে নির্যাতনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হলেও ময়নাতদন্ত ছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।”

কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট প্রফেসর মাইকেল পোলানেন বলেছেন, “গাজায় এখন এক আন্তর্জাতিক ফরেনসিক জরুরি পরিস্থিতি চলছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত অপরিহার্য।”

গাজার ফরেনসিক দল জানায়, ফেরত দেওয়া ১৯৫টি দেহের মধ্যে মাত্র ছয়টির সঙ্গে পরিচয়পত্র ছিল, তার মধ্যেও পাঁচটির নাম ভুল। কিছু দেহে দেখা গেছে আঙুল বা পায়ের আঙুল কেটে নেওয়ার দাগ— যা নিয়ে সন্দেহ করছেন চিকিৎসকেরা, হয়তো ডিএনএ সংগ্রহের জন্য তা করা হয়েছে।

ডা. ধেইর বলেন, “যখন দেখি দেহ উলঙ্গ, হাত বাঁধা, কবজিতে গভীর দাগ— তখন বোঝা যায়, সে জীবিত অবস্থায়ই এমনভাবে মারা গেছে। এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলি হেফাজতে আটক ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে, বিশেষ করে সদে তেইমান নামের সামরিক স্থাপনাটিতে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, বন্দিদের হাত-পা ও চোখ সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঁধা অবস্থায় রাখা হত।

গাজায় এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো— ফেরত আসা মরদেহগুলোর মধ্যে কারা বেসামরিক নাগরিক, কারা হামাস যোদ্ধা, আর কারা ইসরায়েলি হেফাজতে মারা যাওয়া বন্দি— তা শনাক্ত করা।

পরিচয়হীন মরদেহের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জায়গার সংকটে ৫৪টি অজ্ঞাত মরদেহ ইতোমধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছে, অনেক পরিবার জানে না তাদের প্রিয়জনের দেহ আদৌ ফিরে এসেছে কি না।

নিখোঁজ এক ব্যক্তির স্বজন রামি আল-ফারা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “কোনো দেহ কবর দেওয়া খুব কষ্টের, যখন জানি না সেটা আদৌ আমাদের প্রিয়জন কিনা।”

গাজায় যুদ্ধবিরতি হয়তো সাময়িকভাবে গোলাগুলি থামিয়েছে, কিন্তু ফেরত আসা মরদেহগুলোর নির্যাতনের চিহ্ন নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে— যুদ্ধ থামলেও মানবিকতার ক্ষত এখনো গভীর, রক্তাক্ত ও উত্তরহীন।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ০৫:০৫:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
৩০

ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন ইসরায়েল থেকে ফেরত দেওয়া মরদেহে

আপডেট: ০৫:০৫:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

গাজার দক্ষিণাঞ্চলের নাসের হাসপাতালের ছোট একটি ঘরে চলছে মরদেহ শনাক্তের লড়াই। নেই ডিএনএ পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা, নেই সংরক্ষণের জন্য হিমঘর— তবুও ফরেনসিক দল প্রাণপণ চেষ্টা করছে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েল থেকে ফেরত পাওয়া শত শত দেহের পরিচয় নিশ্চিত করতে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গত এগারো দিনে ইসরায়েল ফেরত দিয়েছে ১৯৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ। এর বিনিময়ে গাজা থেকে ফেরত গেছে ১৩ ইসরায়েলি জিম্মির দেহ। কিন্তু ফেরত আসা মরদেহগুলোর অধিকাংশের দেহে নির্যাতনের ভয়াবহ চিহ্ন দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন চিকিৎসকেরা।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে— অনেক দেহই অচেনা, কেউ শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরা, কেউ সম্পূর্ণ উলঙ্গ। অধিকাংশ মরদেহে রয়েছে একাধিক আঘাতের চিহ্ন; কারও হাত বাঁধা, কারও চোখে কাপড়ের ফিতা।

নাসের হাসপাতালের ফরেনসিক ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ ধেইর বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা জায়গার অভাব। দেহগুলো জমাট অবস্থায় আসে, গলতে সময় লাগে কয়েক দিন। ফলে ময়নাতদন্ত বা সঠিক পরিচয় যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। গলতে অপেক্ষা করলে দেহ পচে যায়— তাই যতটা পারি নমুনা সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করি।

আরেক ফরেনসিক সদস্য ডা. আলা আল-আস্তাল জানান, অনেক দেহেই দেখা গেছে কবজি ও গোড়ালির চারপাশে গভীর দাগ, রক্ত জমাট ও টিস্যু ক্ষয়। “কিছু ক্ষেত্রে বাঁধন এত শক্ত ছিল যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি চোখের চারপাশেও ফিতা বাঁধা থাকার দাগ দেখা গেছে,” বলেন তিনি।

গাজার প্রশাসনের সামেহ ইয়াসিন হামাদ বলেন, অনেক দেহে মৃত্যুর আগে মারধর, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, এমনকি ছুরিকাঘাতের চিহ্নও রয়েছে। বিবিসি যাচাই করা ছবিতেও দেখা গেছে কবজি ও পায়ে তারের বাঁধনের ছাপ, কোথাও ত্বক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ক্ষতচিহ্ন।

তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন মেনে কাজ করছে এবং ফেরত দেওয়া মরদেহগুলো গাজার যোদ্ধাদের।

আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এসব ছবিতে নির্যাতনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হলেও ময়নাতদন্ত ছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।”

কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট প্রফেসর মাইকেল পোলানেন বলেছেন, “গাজায় এখন এক আন্তর্জাতিক ফরেনসিক জরুরি পরিস্থিতি চলছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত অপরিহার্য।”

গাজার ফরেনসিক দল জানায়, ফেরত দেওয়া ১৯৫টি দেহের মধ্যে মাত্র ছয়টির সঙ্গে পরিচয়পত্র ছিল, তার মধ্যেও পাঁচটির নাম ভুল। কিছু দেহে দেখা গেছে আঙুল বা পায়ের আঙুল কেটে নেওয়ার দাগ— যা নিয়ে সন্দেহ করছেন চিকিৎসকেরা, হয়তো ডিএনএ সংগ্রহের জন্য তা করা হয়েছে।

ডা. ধেইর বলেন, “যখন দেখি দেহ উলঙ্গ, হাত বাঁধা, কবজিতে গভীর দাগ— তখন বোঝা যায়, সে জীবিত অবস্থায়ই এমনভাবে মারা গেছে। এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলি হেফাজতে আটক ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে, বিশেষ করে সদে তেইমান নামের সামরিক স্থাপনাটিতে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, বন্দিদের হাত-পা ও চোখ সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাঁধা অবস্থায় রাখা হত।

গাজায় এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো— ফেরত আসা মরদেহগুলোর মধ্যে কারা বেসামরিক নাগরিক, কারা হামাস যোদ্ধা, আর কারা ইসরায়েলি হেফাজতে মারা যাওয়া বন্দি— তা শনাক্ত করা।

পরিচয়হীন মরদেহের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জায়গার সংকটে ৫৪টি অজ্ঞাত মরদেহ ইতোমধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছে, অনেক পরিবার জানে না তাদের প্রিয়জনের দেহ আদৌ ফিরে এসেছে কি না।

নিখোঁজ এক ব্যক্তির স্বজন রামি আল-ফারা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “কোনো দেহ কবর দেওয়া খুব কষ্টের, যখন জানি না সেটা আদৌ আমাদের প্রিয়জন কিনা।”

গাজায় যুদ্ধবিরতি হয়তো সাময়িকভাবে গোলাগুলি থামিয়েছে, কিন্তু ফেরত আসা মরদেহগুলোর নির্যাতনের চিহ্ন নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে— যুদ্ধ থামলেও মানবিকতার ক্ষত এখনো গভীর, রক্তাক্ত ও উত্তরহীন।