১১:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

ইরানের ‘গায়েব’ ইউরেনিয়াম: বোমারু ধ্বংস নাকি গোপন সংরক্ষণ?

ডেস্ক নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫ছবি: রয়টার্স

প্রকাশকাল: ১ জুলাই ২০২৫
লেখক: আনোয়ার বিন মাহামুদ

ভূমিকা: এক অদৃশ্য শঙ্কা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলায় ইরানের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা—ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এসব হামলা সামরিকভাবে সফল হলেও এর এক গভীর কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে: ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায়?

এই প্রশ্ন শুধু জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ নয়, বরং সারা বিশ্বকে এক অদৃশ্য অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। ৪০০ কেজির বেশি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম—যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পর্যায়ে ছিল—এখন কোথায়, তা কেউ জানে না।

ফর্দোতে আগেই সরানো হয়েছিল ইউরেনিয়াম?

হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার বাইরে ট্রাকের সারি দাঁড়িয়ে ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে, হামলার আগেই ইরান সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় ইউরেনিয়াম অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে পারে।

আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিজেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৩ জুন ইসরায়েলের প্রথম হামলার দিন ইরান জানিয়েছিল, তারা তাদের পারমাণবিক উপকরণ নিরাপদে সরিয়ে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে কোথায় এবং কীভাবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে: ‘সরাতে পারেনি’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব সন্দেহকে সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছেন। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ইরানিরা কিছুই সরাতে পারেনি। এটা খুব ভারী, খুব কঠিন। আর আমরা তাদের আগেভাগে জানাইনি।”

এমন বক্তব্যে মার্কিন প্রশাসন নিজেদের হামলার সাফল্য নিশ্চিত করতে চাইলেও গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা বিষয়টি অতটা সরলভাবে দেখছেন না। কারণ, ইউরেনিয়ামের সরবরাহ সরানো যেমন কঠিন, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক সময় অপ্রকাশ্য তথ্যও থাকতে পারে।

আইএইএর বিপাকে পড়া তদন্ত

বর্তমানে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে, তারা নিশ্চিত নয় ইরানের ৯ টন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কতটুকু ধ্বংস হয়েছে আর কতটুকু অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ যে ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম রয়েছে, তা দিয়ে অন্তত নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব।

আইএইএর সাবেক প্রধান পরিদর্শক অলি হেইনোনেন বলেছেন, “ধ্বংসস্তূপের নিচে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, আবার এমন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে পৌঁছানো কঠিন। তদন্তে ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ, পরিবেশ বিশ্লেষণ—সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ও জটিল।”

গোপন ইউরেনিয়াম মানেই পরমাণু অস্ত্র?

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইরান এখনই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। তবে তারা ভবিষ্যতে ওই সক্ষমতা রাখতে চাইছে। আইএইএ এখনো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ বলতেও পারছে না, আবার সরাসরি অস্ত্র কর্মসূচির প্রমাণও দিতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে, কোনো কিছুর সামান্য তথ্য অনুপস্থিত থাকাও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে।

আইএইএর সীমাবদ্ধতা: চোর-পুলিশ খেলা?

আইএইএর তদন্ত করার ক্ষমতা শুধু ঘোষিত স্থাপনাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা আকস্মিকভাবে গোপন বা অঘোষিত স্থানে তদন্ত চালাতে পারে না, যদি না ইরান নিজে অনুমতি দেয়।

এর ফলে পরিদর্শক সংস্থার কাজ প্রায় ‘ছায়ার পিছু ধাওয়া’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা করছেন—যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের তথ্য ছিল অনির্ভরযোগ্য।

রাজনৈতিক বাস্তবতা: আন্তর্জাতিক মতবিভাজন

ইরানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিতের প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো এখন মরিয়া হয়ে সেই ‘অদৃশ্য ইউরেনিয়াম’-এর হদিস খুঁজছে।

উপসংহার: অজানার ভেতরে বিশ্বনিরাপত্তা

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে স্পষ্টতা এখন বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য অন্যতম জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি ইরান সত্যিই ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলে গোপনে রেখেই থাকে, তবে ভবিষ্যতের কোনো একদিন সেই উপকরণ দিয়ে আবার সমৃদ্ধকরণ শুরু হতে পারে। আর যদি সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকে, তবুও বিশ্বকে তা প্রমাণ করতে হবে—অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ তথ্য দিয়ে।

এই মুহূর্তে, বিশ্ব কেবল অনুমান করতে পারছে, প্রকৃত সত্য হয়তো এখনো পাহাড়ের গহীনে চাপা পড়ে আছে—ইরানের ধ্বংসস্তূপে।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ১১:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

ইরানের ‘গায়েব’ ইউরেনিয়াম: বোমারু ধ্বংস নাকি গোপন সংরক্ষণ?

আপডেট: ১১:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইটে তোলা ইরানের ফর্দো ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনার দৃশ্য। কোম, ইরান, ২০ জুন ২০২৫ (বাঁয়ের ছবি) ও ২২ জুন ২০২৫ছবি: রয়টার্স

প্রকাশকাল: ১ জুলাই ২০২৫
লেখক: আনোয়ার বিন মাহামুদ

ভূমিকা: এক অদৃশ্য শঙ্কা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলায় ইরানের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা—ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এসব হামলা সামরিকভাবে সফল হলেও এর এক গভীর কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে: ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কোথায়?

এই প্রশ্ন শুধু জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ নয়, বরং সারা বিশ্বকে এক অদৃশ্য অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। ৪০০ কেজির বেশি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম—যা পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পর্যায়ে ছিল—এখন কোথায়, তা কেউ জানে না।

ফর্দোতে আগেই সরানো হয়েছিল ইউরেনিয়াম?

হামলার আগে ও পরে স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনার বাইরে ট্রাকের সারি দাঁড়িয়ে ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে, হামলার আগেই ইরান সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় ইউরেনিয়াম অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে পারে।

আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিজেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ১৩ জুন ইসরায়েলের প্রথম হামলার দিন ইরান জানিয়েছিল, তারা তাদের পারমাণবিক উপকরণ নিরাপদে সরিয়ে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে কোথায় এবং কীভাবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র বলছে: ‘সরাতে পারেনি’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব সন্দেহকে সরাসরি উড়িয়ে দিয়েছেন। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ইরানিরা কিছুই সরাতে পারেনি। এটা খুব ভারী, খুব কঠিন। আর আমরা তাদের আগেভাগে জানাইনি।”

এমন বক্তব্যে মার্কিন প্রশাসন নিজেদের হামলার সাফল্য নিশ্চিত করতে চাইলেও গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা বিষয়টি অতটা সরলভাবে দেখছেন না। কারণ, ইউরেনিয়ামের সরবরাহ সরানো যেমন কঠিন, তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক সময় অপ্রকাশ্য তথ্যও থাকতে পারে।

আইএইএর বিপাকে পড়া তদন্ত

বর্তমানে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএ স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে, তারা নিশ্চিত নয় ইরানের ৯ টন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কতটুকু ধ্বংস হয়েছে আর কতটুকু অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ যে ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম রয়েছে, তা দিয়ে অন্তত নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব।

আইএইএর সাবেক প্রধান পরিদর্শক অলি হেইনোনেন বলেছেন, “ধ্বংসস্তূপের নিচে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, আবার এমন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে পৌঁছানো কঠিন। তদন্তে ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ, পরিবেশ বিশ্লেষণ—সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ও জটিল।”

গোপন ইউরেনিয়াম মানেই পরমাণু অস্ত্র?

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইরান এখনই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। তবে তারা ভবিষ্যতে ওই সক্ষমতা রাখতে চাইছে। আইএইএ এখনো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ বলতেও পারছে না, আবার সরাসরি অস্ত্র কর্মসূচির প্রমাণও দিতে পারছে না।

এমন পরিস্থিতিতে, কোনো কিছুর সামান্য তথ্য অনুপস্থিত থাকাও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে।

আইএইএর সীমাবদ্ধতা: চোর-পুলিশ খেলা?

আইএইএর তদন্ত করার ক্ষমতা শুধু ঘোষিত স্থাপনাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা আকস্মিকভাবে গোপন বা অঘোষিত স্থানে তদন্ত চালাতে পারে না, যদি না ইরান নিজে অনুমতি দেয়।

এর ফলে পরিদর্শক সংস্থার কাজ প্রায় ‘ছায়ার পিছু ধাওয়া’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সঙ্গে এর তুলনা করছেন—যেখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের তথ্য ছিল অনির্ভরযোগ্য।

রাজনৈতিক বাস্তবতা: আন্তর্জাতিক মতবিভাজন

ইরানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিতের প্রস্তাবে ভোট দিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো এখন মরিয়া হয়ে সেই ‘অদৃশ্য ইউরেনিয়াম’-এর হদিস খুঁজছে।

উপসংহার: অজানার ভেতরে বিশ্বনিরাপত্তা

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে স্পষ্টতা এখন বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য অন্যতম জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি ইরান সত্যিই ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলে গোপনে রেখেই থাকে, তবে ভবিষ্যতের কোনো একদিন সেই উপকরণ দিয়ে আবার সমৃদ্ধকরণ শুরু হতে পারে। আর যদি সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকে, তবুও বিশ্বকে তা প্রমাণ করতে হবে—অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ তথ্য দিয়ে।

এই মুহূর্তে, বিশ্ব কেবল অনুমান করতে পারছে, প্রকৃত সত্য হয়তো এখনো পাহাড়ের গহীনে চাপা পড়ে আছে—ইরানের ধ্বংসস্তূপে।