০২:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

শিক্ষকের স্কেলের আঘাতে চোখ হারাল সাত বছরের শিশু, আট মাসেও বিচার পায়নি পরিবার

ডেস্ক নিউজ

স্থান: কুমিল্লা 

কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় শিক্ষক কর্তৃক স্কেল ছুড়ে মারার ঘটনায় চোখ হারিয়েছে সাত বছর বয়সী শিশু ফারহান ইসলাম রোহান। ঘটনার আট মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত শিক্ষক এখনো পলাতক। চিকিৎসার খরচ ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিশেহারা পরিবার ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার বাতাকান্দি এলাকার সেবা মাল্টিমিডিয়া স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ফারহান ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে হইচই করছিল। অভিযোগ রয়েছে, সহকারী শিক্ষক রাহাতুল ইসলাম সৌরভ (২৫) রাগান্বিত হয়ে প্রথমে স্কেল দিয়ে ফারহানের পিঠে আঘাত করেন। স্কেলটি ভেঙে গেলে তা ছুড়ে মারেন, যা ফারহানের ডান চোখে আঘাত করে।

ফারহানের মা মায়া আক্তার বলেন, “দৌড়ে গিয়ে দেখি আমার ছেলে চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে।”

চিকিৎসার জন্য ফারহানকে কুমিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং পরে ভারতেও নিতে হয়েছে। ইতোমধ্যে তার দুই দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানায় পরিবার।

শিশুটির বাবা রবিউল ইসলাম ওমানপ্রবাসী। ছেলের খবর শুনে তিনি দেশে ফিরে এসে তিন মাস ধরে চিকিৎসার তদারকি করেন। বর্তমানে ফারহান স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এক চোখে দেখতে না পারায় পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছে না।

ঘটনার পাঁচ দিন পর, ৮ সেপ্টেম্বর ফারহানের মা তিতাস থানায় মামলা দায়ের করেন। দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারা অনুযায়ী গুরুতর আঘাতজনিত এ মামলায় অভিযুক্ত রাহাতুল ইসলামের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত এখনো পলাতক।

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কাউছার বলেন, “আমরা অভিযুক্তকে ধরার চেষ্টা করছি।”

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা মো. শামীম সরকার বলেন, “ঘটনার পর শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা চিকিৎসার খরচ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি।”

অন্যদিকে অভিযুক্ত শিক্ষকের মা শিল্পী আক্তার বলেন, “আমার ছেলে ইচ্ছা করে কাজটা করেনি। ভুল হয়েছে, আমরা সমাধান চাই। কিন্তু ওই পরিবার আলোচনায় আসতে চায় না।”

তবে ফারহানের পরিবার বলছে, একটি শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার বিষয়টি কোনোভাবেই ‘মীমাংসা’ হতে পারে না। “আমার পুতের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছে। আমরা বিচার চাই,” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন মায়া আক্তার।

তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমাইয়া মমিন বলেন, “প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছে। যদিও এটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল হওয়ায় প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপ সীমিত, তারপরও আমরা নজর রাখছি।”

জাতীয় প্রেক্ষাপট: শিশুদের শারীরিক শাস্তি এখনো বাস্তবতা

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের উপর সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরণ নীতিমালা, ২০১১’ বলবৎ থাকলেও তা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ পরিচালিত ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৮৯ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ শিশু গুরুতর শাস্তি পায়।

শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং কঠোর নজরদারির দাবি জানাচ্ছেন অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও অধিকারকর্মীরা।

Please Share This Post in Your Social Media

আপডেট: ১২:৪১:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

শিক্ষকের স্কেলের আঘাতে চোখ হারাল সাত বছরের শিশু, আট মাসেও বিচার পায়নি পরিবার

আপডেট: ১২:৪১:১৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

স্থান: কুমিল্লা 

কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় শিক্ষক কর্তৃক স্কেল ছুড়ে মারার ঘটনায় চোখ হারিয়েছে সাত বছর বয়সী শিশু ফারহান ইসলাম রোহান। ঘটনার আট মাস পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত শিক্ষক এখনো পলাতক। চিকিৎসার খরচ ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিশেহারা পরিবার ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছে।

২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার বাতাকান্দি এলাকার সেবা মাল্টিমিডিয়া স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ফারহান ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে হইচই করছিল। অভিযোগ রয়েছে, সহকারী শিক্ষক রাহাতুল ইসলাম সৌরভ (২৫) রাগান্বিত হয়ে প্রথমে স্কেল দিয়ে ফারহানের পিঠে আঘাত করেন। স্কেলটি ভেঙে গেলে তা ছুড়ে মারেন, যা ফারহানের ডান চোখে আঘাত করে।

ফারহানের মা মায়া আক্তার বলেন, “দৌড়ে গিয়ে দেখি আমার ছেলে চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে।”

চিকিৎসার জন্য ফারহানকে কুমিল্লা, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং পরে ভারতেও নিতে হয়েছে। ইতোমধ্যে তার দুই দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানায় পরিবার।

শিশুটির বাবা রবিউল ইসলাম ওমানপ্রবাসী। ছেলের খবর শুনে তিনি দেশে ফিরে এসে তিন মাস ধরে চিকিৎসার তদারকি করেন। বর্তমানে ফারহান স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এক চোখে দেখতে না পারায় পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছে না।

ঘটনার পাঁচ দিন পর, ৮ সেপ্টেম্বর ফারহানের মা তিতাস থানায় মামলা দায়ের করেন। দণ্ডবিধির ৩২৬ ধারা অনুযায়ী গুরুতর আঘাতজনিত এ মামলায় অভিযুক্ত রাহাতুল ইসলামের সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত এখনো পলাতক।

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কাউছার বলেন, “আমরা অভিযুক্তকে ধরার চেষ্টা করছি।”

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা মো. শামীম সরকার বলেন, “ঘটনার পর শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা চিকিৎসার খরচ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরিবার রাজি হয়নি।”

অন্যদিকে অভিযুক্ত শিক্ষকের মা শিল্পী আক্তার বলেন, “আমার ছেলে ইচ্ছা করে কাজটা করেনি। ভুল হয়েছে, আমরা সমাধান চাই। কিন্তু ওই পরিবার আলোচনায় আসতে চায় না।”

তবে ফারহানের পরিবার বলছে, একটি শিশুর চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার বিষয়টি কোনোভাবেই ‘মীমাংসা’ হতে পারে না। “আমার পুতের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছে। আমরা বিচার চাই,” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন মায়া আক্তার।

তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমাইয়া মমিন বলেন, “প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছে। যদিও এটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল হওয়ায় প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপ সীমিত, তারপরও আমরা নজর রাখছি।”

জাতীয় প্রেক্ষাপট: শিশুদের শারীরিক শাস্তি এখনো বাস্তবতা

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের উপর সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিতকরণ নীতিমালা, ২০১১’ বলবৎ থাকলেও তা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ পরিচালিত ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৮৯ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ শিশু গুরুতর শাস্তি পায়।

শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং কঠোর নজরদারির দাবি জানাচ্ছেন অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও অধিকারকর্মীরা।