রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ: যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া শুরু! চামড়া ও পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ স্থগিতের ধাক্কা
ঢাকার সাভারের এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টস চলতি সপ্তাহে তিন লাখ মার্কিন ডলারের চামড়ার ব্যাগ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গতকাল রোববার সকালে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বার্তা পাঠিয়ে পণ্য জাহাজীকরণ না করার নির্দেশনা দেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম মুশফিকুর রহমান জানান, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মূল্যছাড় চাইছে, যা বাড়তি শুল্কের কারণে লোকসান মেটাতে সাহায্য করবে।
এসেন্সর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার প্রোডাক্টসের মতো আরও কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত রাখার নির্দেশনা পেয়েছে। কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মূল্যছাড় চেয়েছে বলেও জানা গেছে।
ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি ও বাংলাদেশের ওপর প্রভাব
দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন, যেখানে বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে এই শুল্কহার ২৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ২৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ এবং চীনের ওপর মোট শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশ।
শুল্কহার নির্ধারণে মার্কিন প্রশাসন একটি সূত্র প্রয়োগ করেছে, যেখানে নির্দিষ্ট দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে তার অর্ধেক শুল্ক হিসেবে আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই শুল্ক হার দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ, যার অর্ধেক বা ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ স্থগিত ও মূল্যছাড়ের চাপ
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যার একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকেই দেশের পোশাক রপ্তানিকারকেরা উদ্বিগ্ন। উইকিটেক্স–বিডি নামে একটি বায়িং হাউসের তিন লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, যদিও সে ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদনের জন্য ইতিমধ্যে কাপড়ও আমদানি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম সাইফুর রহমান জানান, মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায়ের কোনো সুযোগ নেই বলে আমাদের দাম কমাতে বলছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) নেতারা জানান, একটি বায়িং হাউস প্রতি মাসে ১২ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানে রপ্তানি করে। পাল্টা শুল্ক আরোপের পর সেই মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যেসব পণ্য জাহাজীকরণ হয়েছে, সেসব পণ্যে মূল্যছাড় দাবি করেছে এবং আগামী জুনের ক্রয়াদেশও স্থগিত করেছে। জুলাই থেকে পণ্য পাঠাতে হবে না তা জানিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
রপ্তানিকারকদের প্রতিক্রিয়া ও আশঙ্কা
প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর জানান, যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে দুই দিন ক্রেতা প্রতিনিধিদের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে সোমবার থেকে ক্রেতারা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন তৈরি পোশাকসহ অন্য খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে রপ্তানিকারকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে এই সংকটের সমাধান না হলে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক জানান, রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের ৩৭ শতাংশ শুল্ক বহন করতে বলছে এবং ক্রয়াদেশ স্থগিত করার নির্দেশনাও আসছে।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও চামড়া শিল্প, বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রয়াদেশ স্থগিত ও মূল্যছাড়ের দাবির কারণে রপ্তানিকারকেরা উদ্বেগে রয়েছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।